ভুট্টার সাইলেজ তৈরির পদ্ধতি | সাইলেজের জন্য ভুট্টা চাষ পদ্ধতি

 
ভুট্টার সাইলেজ তৈরির পদ্ধতি

সাইলেজের জন্য ভুট্টা চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে খামারিদের জন্য সারা বছর গরু ও ছাগলের খাবার জোগানো সহজ নয়। বিশেষ করে খরার সময় সবুজ পশুখাদ্যের অভাব দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধানে সাইলেজ তৈরি একটি চমৎকার সমাধান। সাইলেজ হলো ভুট্টা বা অন্যান্য সবুজ ঘাস নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে রাখা খাবার, যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত নষ্ট হয় না। সঠিকভাবে ভুট্টা চাষ করলে সাইলেজে উচ্চ মানের পুষ্টি পাওয়া যায়, যা দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।

সঠিক সময় ও ফসল ক্যালেন্ডার

বাংলাদেশে ভুট্টা সাধারণত রবি মৌসুমে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) বেশি চাষ হয়। এছাড়া খরিফ মৌসুমেও (মার্চ–এপ্রিল) জমি ও আবহাওয়া অনুকূল হলে চাষ করা যায়। বপনের পর থেকে সাধারণত ৮৫–১০০ দিনের মধ্যে ফসল কাটাই করা যায়। সাইলেজ তৈরির জন্য ভুট্টা কাটার সেরা সময় হলো যখন দানা মিল্ক-ডো স্টেজে পৌঁছে।

জাত নির্বাচন

সাইলেজের জন্য এমন ভুট্টার জাত নির্বাচন করতে হবে যেগুলো সবুজ ভর বেশি দেয়, দানা মাঝারি শক্ত হয় এবং রোগবালাই কম হয়। হাইব্রিড জাত সাধারণত ভালো ফলন দেয়। এছাড়া স্থানীয়ভাবে সহজে পাওয়া যায় এমন জাত বেছে নেওয়াই ভালো।

মাঠ প্রস্তুতি

ভুট্টা চাষের জন্য উর্বর দো–আঁশ বা বেলে দো–আঁশ মাটি উপযুক্ত। মাটির pH ৬.০ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হলে সবচেয়ে ভালো। জমি ২–৩ বার চাষ করে ঝুরঝুরে করতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রতি একরে ৫–৮ টন জৈব সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে জমি প্রস্তুত করলে ফলন বাড়ে।

বীজ বপন পদ্ধতি

  • সারি দূরত্ব: ৬০–৭৫ সেমি
  • গাছের দূরত্ব: ২০–২৫ সেমি
  • বীজের গভীরতা: ৩–৫ সেমি
  • বীজের পরিমাণ: ৮–১০ কেজি/একর

বপনের আগে বীজ ফাঙ্গিসাইড দিয়ে ট্রিট করলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয় এবং চারায় রোগ কম হয়।

সার ব্যবস্থাপনা

সঠিক সার ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া কঠিন। সাধারণত একরপ্রতি:

  • ইউরিয়া: ৪০–৬০ কেজি (৩ ধাপে প্রয়োগ)
  • টিএসপি: ২০–২৫ কেজি
  • এমওপি: ১৫–২০ কেজি
  • সালফার: ৫–৮ কেজি

প্রথম ধাপে ইউরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ, বাকি দুই ধাপে গাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ব্যবস্থাপনা

ভুট্টা চাষে সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে অঙ্কুরোদগম, ৫–৬ পাতার সময়, ফুল ফোটা এবং শস্য ভরার সময় সেচ দেওয়া আবশ্যক। সাধারণত ৭–১০ দিন অন্তর একবার সেচ দিতে হয়। জমিতে পানি জমে থাকলে দ্রুত নিষ্কাশন করতে হবে।

আগাছা, পোকা ও রোগবালাই দমন

আগাছা নিয়ন্ত্রণ: বপনের ২০–২৫ দিন ও ৪৫ দিন পর নিড়ানি দেওয়া জরুরি।

পোকা দমন: স্টেম বোরার ও ফলকীট বেশি দেখা যায়। ফেরোমন ফাঁদ বা আলো ফাঁদ ব্যবহার করা যায়।

রোগ দমন: ব্লাইট ও রস্ট রোগ বেশি দেখা যায়। রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার ও প্রয়োজনে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

কাটিং স্টেজ ও হারভেস্ট

সাইলেজের জন্য ভুট্টা কাটার সেরা সময় হলো মিল্ক–ডো স্টেজ। এসময় শস্যদানা নরম আটা সদৃশ হয় এবং গাছের শুকনো পদার্থ বা ড্রাই ম্যাটার ৩০–৩৫% থাকে। সাধারণত জমি থেকে ১০–১৫ সেমি উপরে কেটে নিতে হয়।

সাইলেজ বানানোর পদ্ধতি

ফসল প্রস্তুত

ভুট্টা কেটে ১–২ সেমি আকারে চপ করতে হয়। ছোট চপ করলে কমপ্যাকশন ভালো হয় এবং বাতাস ঢুকতে পারে না।

সাইলো পিট তৈরি

সাইলেজ সংরক্ষণের জন্য মাটির নিচে গর্ত বা সাইলো পিট তৈরি করা যায়। পলিথিন দিয়ে ঢেকে তার ওপর মাটি বা বস্তা দিয়ে চাপা দিতে হয়। চাইলে ড্রাম বা প্লাস্টিক ব্যাগেও সংরক্ষণ করা যায়।

ইনসাইলিং প্রক্রিয়া

প্রতিটি স্তরে কাটা ভুট্টা রেখে ভালোভাবে চাপ দিয়ে বাতাস বের করতে হবে। এভাবে স্তরভিত্তিক ভরে পুরো পিট ভরার পর উপরে পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। বাতাস একেবারে ঢুকতে না পারলে ভালো মানের সাইলেজ হবে। ২১–৪৫ দিন পর্যন্ত সিল করা অবস্থায় রাখতে হবে।

মান নিয়ন্ত্রণ

ভালো সাইলেজের বৈশিষ্ট্য:

টক-মিষ্টি গন্ধ থাকবে

রঙ হবে জলপাই সবুজ থেকে হালকা বাদামি

ছত্রাক বা পচা গন্ধ থাকবে না

সম্ভাব্য উৎপাদন ও লাভ

সঠিক পরিচর্যায় প্রতি একর জমি থেকে ২৫–৩৫ টন সবুজ ভুট্টা পাওয়া যায়। সাইলেজ সংরক্ষণের মাধ্যমে খামারি সারা বছর পশুখাদ্য নিশ্চিত করতে পারে। এতে খাবার কেনার খরচ কমে এবং দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়ে।

সাধারণ ভুল ও সমাধান

দেরি করে কাটাই: ভুট্টা অতিরিক্ত শুকিয়ে যায় → মিল্ক–ডো স্টেজে কাটুন।

কমপ্যাকশন দুর্বল: ছত্রাক ধরে যায় → প্রতিটি স্তরে ভালোভাবে চাপ দিন।

অতিরিক্ত ভেজা ফসল: রস বের হয়ে পুষ্টি নষ্ট হয় → ১–২ দিন ছায়ায় শুকিয়ে নিন।

সঠিকভাবে সিল না করা: বাতাস ঢুকে গরম হয় → দ্বিগুণ পলিথিন ব্যবহার করুন।

৫টি সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

১. কোন ভুট্টার জাত সাইলেজের জন্য উপযুক্ত?

উচ্চ ফলনশীল, সবুজ ভর বেশি এবং ৮৫–৯৫ দিনে পরিপক্ক হয় এমন হাইব্রিড জাত।

২. কখন ভুট্টা কাটলে সেরা মানের সাইলেজ পাওয়া যায়?

দানা মিল্ক–ডো স্টেজে থাকলে।

৩. সাইলেজ কতদিন সংরক্ষণ করা যায়?

ভালোভাবে সংরক্ষণ করলে ১ বছর পর্যন্ত মান ঠিক থাকে।

৪. ইনোকুল্যান্ট ব্যবহার করা কি জরুরি?

অবশ্যই নয়, তবে ব্যবহার করলে গুণগত মান আরও ভালো হয়।

৫. সাইলেজ খাওয়ালে দুধ কি বাড়ে?

হ্যাঁ, কারণ এতে উচ্চ পুষ্টিমান থাকে যা দুধ উৎপাদনে সহায়ক।

উপসংহার

সঠিক সময়ের কাটাই, ভালো কমপ্যাকশন এবং এয়ারটাইট সংরক্ষণ—এই তিনটি ধাপ ঠিকমতো মেনে চললে ভুট্টা দিয়ে তৈরি সাইলেজের মান সর্বোচ্চ হয়। বাংলাদেশের খামারিদের জন্য এটি শুধু খরচ সাশ্রয়ী নয়, বরং সারা বছর পশুখাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url